তথ্যমতে জানা যায় যে, আদিকালের সভ্যতার সৃষ্টিলগ্নে যখন টোটেম গ্রুপের আওতায় মানুষ সমাজবদ্ধ হতে শুরু করে, তখন পরোক্ষভাবে সমবায়ী মনোভাবের সূত্রপাত হয়। সত্যি কথা বলতে কি, সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে মানুষের প্রতিটি কর্মধারায় অনানুষ্ঠানিকভাবে সমবায়ী দর্শন প্রতিফলিত হয়ে থাকে। এদিকে বর্তমান বিশ্বের ১৯৩টি দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে সমবায়ভিত্তিক আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে থাকে। আর জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বে প্রায় ৩০০ কোটি মানুষ সমবায়ের মাধ্যমে জীবিকানির্বাহ করে থাকে। মূলত বিশ্বে গড়ে প্রায় ছয় জনে একজন সমবায়ী, যা কম কথা নয়? এদিকে বর্তমান বাংলাদেশে ছোট-বড় মিলে প্রায় ১ লাখ ৭৪ হাজার ৭০০টির মতো সমবায় সমিতি রয়েছে, যাতে ব্যক্তি সদস্য আছে প্রায় ১ কোটি ৯ লাখ এবং এর কার্যকরী মূলধনের পরিমাণ প্রায় ১৩ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সমবায়ের মাধ্যমে যে সম্ভাবনার পুষ্প বিদ্যমান, তা এখনো পুরোপুরি সৌরভসহ পাপড়ি ছড়িয়ে প্রস্ফুটিত হতে পারেনি। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো যে, এ বিশ্বে মোট সম্পদের ৯০ শতাংশের মালিক ১০ শতাংশ জনগণ। আর অবশিষ্ট ১০ শতাংশ সম্পদের মালিক ৯০ শতাংশ জনগণ। এক্ষেত্রে শুধু সম্পদের অসম বণ্টন পরিলক্ষিত হয়। আর এর ফলশ্রুতিতে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মানুষের মধ্যে জীবনযাত্রার বিরাট পার্থক্য দেখা যায়। শুধু তাই নয়, এর কারণে প্রায়ই আর্থসামাজিক দিক দিয়ে ছন্দপতন হয়ে থাকে। আর তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট তো আপনাদের জানা। মূলত সমবায় হচ্ছে সুষম বণ্টনসহ ঐক্যের পথ ধরে যৌথভাবে ওপরে ওঠার দর্শন। আর এক্ষেত্রে এক বাবার পাঁচ ছেলের একত্রে থাকার সেই জনপ্রিয় গল্পের ন্যায় সমবায়ই পারে ভরসার পরিবেশ তৈরি করতে। আর এটি প্রকারান্তরে মস্ত বড় সম্পদ। যার ওপর কবিগুরু প্রভূত গুরুত্ব দিয়েছেন। এই ঐক্যের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন যে, যদি একা অন্ন ভক্ষণ করা যায়, তাতে হয়তো পেট ভরে। কিন্তু পাঁচ জন মিলে ভক্ষণ করলে পেটও ভরে আবার আনন্দও মিলে এবং একই সঙ্গে একত্রে থাকার পথ ধরে আত্মরক্ষার পথ সুগম হয়। রবি ঠাকুরের এই কথায় কি বুঝাতে চেয়েছেন, তা হয়তো আপনাদের বিশ্লেষণ করে বলতে হবে না বলে মনে করি।

 

ইতিমধ্যে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এক্ষেত্রে অন্যান্য প্যারামিটারের মধ্যে সমবায়কে এতটাই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে যে, বাংলাদেশের সংবিধানের ১৩ (খ) অনুচ্ছেদে এটি বিশেষভাবে সন্নিবেশন করা হয়েছে। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রাদেশিক শাসন আমলে স্বল্প সময়ের জন্য কৃষি ও সমবায় মন্ত্রী ছিলেন। তখন তিনি সমবায়ের দর্শন গভীরভাবে অনুধাবন করেছিলেন। আর এরই ধারাবাহিকতায় সমবায় আমাদের সংবিধানের জায়গা করে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, সেই আদর্শ বাস্তবায়নের ফল হিসেবে বিশ্বে বাংলাদেশ সমবায়ী কর্মকাণ্ডে বিশেষ অবস্থান নিয়ে আছে। অবশ্য এক্ষেত্রে যার কথা না বললে কমতি থেকে যাবে, তিনি হলেন বাংলাদেশের সমবায় আন্দোলনের পথিকৃত্ আক্তার হামিদ খান। তার কর্তৃক প্রবর্তিত কুমিল্লা মডেলটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।

 

বাংলাদেশে সমবায় কার্যক্রম যতখানি আশা করা হয়েছিল। অতখানি সফলতা না হলেও যতখানি হয়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কেননা দেশের ব্যবসাবাণিজ্য, শিল্প, পরিবহন, সংখ্যালঘু, এনজিও, শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সমবায় কার্যক্রম যতখানি হয়েছে, তা খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। আর এখন যে সেক্টরের কথা বলব, তা অন্যভাবে নিবেন না। আর এটা তত্ত্ব কথা নয়, বাস্তব। কেননা আমি ছোটবেলায় দেখেছি, আমাদের দেশে ঋতুভিত্তিক কৃষি কার্যক্রম চলত। এক বছর সময়মতো মৌসুমি বৃষ্টি হলেও আরেক বছর হতো না। আবার এক বার অতিবৃষ্টি, আরেক বার অনাবৃষ্টির কবলে পড়ে হয় খরা, না হয় বন্যার লুকোচুরিতে দিগিবদিক শূন্য হয়ে পড়ত বিধায় প্রায় প্রতি বছর অন্নাভাবে হাহাকার লেগেই থাকত। কিন্তু স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) কতিপয় থানা লেভেলে প্রকল্প নেয়। তাতে উচ্চফলনশীল বীজ, সার, সেচ, (Irrigation) পাওয়ার টিলার (কলের লাঙল) ইত্যাদি ব্যবহার শুরু করে। এই কার্যক্রমমূলক সেবা এককভাবে শুধু একজন কৃষকের দেওয়া সম্ভব ছিল না বিধায় সমবায়ের মাধ্যমে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। আর এক্ষেত্রে বলতে দ্বিধা নেই যে, তখন থেকে বাংলাদেশে দিনে দিনে ফসল উত্পাদন বেড়ে যেতে থাকে। আর সেই সুবাদে এখন বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতার ঢাকঢোল পিটাচ্ছে। এ কথাগুলো এ কারণে বললাম, তখন যদি কৃষিতে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে সমবায়ী কার্যক্রম গ্রহণ করা না হতো। তাহলে স্বয়ংসম্পূর্ণতা তো দূরে থাক। হয়তো পূর্বের ন্যায় খাদ্যাভাব (Food Crisis) লেগেই থাকত।

 

এতক্ষণ স্বল্প পরিসরে সমবায়ের ইতি কথাসহ এর গুরুত্ব নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করেছি। এবার সূক্ষ্মভাবে এর মাহাত্ম্য যে কত গভীর পর্যন্ত গ্রোথিত, তা নিয়ে যতকিঞ্চিত্ তুলে ধরছি। বস্তুত এ প্রেক্ষাপটে সমবায়ী তথা সদস্যদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি বিষয় পরোক্ষভাবে সূক্ষ্মতার আড়ালে শিকড় গেড়ে বসে, তা হলো ঐক্য ও পারস্পরিক সহমর্মিতা, যার ফলে অজান্তেই একে অন্যের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ ধীরে ধীরে কমে আসে। তাই আমরা জোর গলায় বলতে পারি যে, কেবল আর্থসামাজিক উন্নয়ন নয়, আদি ভিত হিসেবে সমবায় ঐক্য ও পারস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করে থাকে।

কি খুজছেন এখানে লিখুন