সমিতি, মাল্টিপারপাস, কিস্তি ইত্যাদি শব্দকে অনেকেই সুদের সমার্থবোধক জানেন। এ জানার পেছনে যথেষ্ট বাস্তবতাও আছে।
ইদানীং দেশের প্রতিটি শহর ও গ্রামের মার্কেটে, হাটে, মোড়ে গড়ে উঠেছে প্রচুর সমবায় সমিতি, সঞ্চয়ী সমিতি, মাল্টিপারপাস ইত্যাদি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এগুলোর প্রায় সবই সুদভিত্তিক পরিচালিত হয়।
এগুলো দেখতে দেখতে সাধারণ মানুষ এখন কিস্তি, সমিতি, মাল্টিপারপাস শুনলেই মনে করে সুদের কারবার। অথচ সুদমুক্ত থেকেও এসব সমিতি পরিচালনা করা সম্ভব।
এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা একটু আন্তরিক হলে, নিজেদের ও উম্মাহর ইমান- আমলের প্রতি একটু দরদি হলে প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুদমুক্ত লাভজনক করতে পারেন।
সুদ ও লাভ কিন্তু এক নয়।
আবার বিপরীতও নয়। সব সুদই লাভ। কিন্তু সব লাভ সুদ নয়। লাভ দুই ধরনের। একটা লাভ সুদমুক্ত, অন্যটা সুদ। তিনটি বিষয়কে সামনে রাখলে আমরা খুব সহজেই চিহ্নিত করতে পারব, আমাদের কোন লাভ সুদ হচ্ছে আর কোন লাভ সুদ নয়।
১. টাকা বনাম টাকার আদান-প্রদানে যে লাভ দেওয়া-নেওয়া হবে তা সুদ। ভিন্ন ভিন্ন মুদ্রার বিনিময় বা আদান-প্রদানের লাভ সুদ নয়। ২. পণ্য বনাম পণ্যের আদান-প্রদানে যদি উভয় পণ্যের জাত এক হয় তাহলে যে লাভ দেওয়া-নেওয়া হবে তা সুদ। ৩. পণ্য বনাম টাকার বাকি বেচাকেনাতে চুক্তি মোতাবেক নির্দিষ্ট সময়ে বিনিময় পরিশোধ না হলে পূর্বনির্ধারিত বিনিময়ের চেয়ে অতিরিক্ত যা দেওয়া-নেওয়া হবে তা সুদ।
পক্ষান্তরে নগদ মূল্যের তুলনায় বাকি মূল্য বেশি ধার্য করে বিক্রি করলে তা সুদ নয়। অনুরূপ স্বল্প বাকির তুলনায় দীর্ঘ বাকির মূল্য বেশি ধার্য করে বিক্রি করলে তা সুদ নয়। তবে এর জন্য শর্ত হলো, বিক্রির আগেই বাকির ধরন ও মূল্যের পরিমাণ ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে সুনির্দিষ্ট করা। ঝুলন্ত রাখলে বা ক্রেতা-বিক্রেতার জন্য ঐচ্ছিক সুযোগ বাকি রাখলে তা সুদ হবে।
সমিতিকে সুদমুক্ত রাখার জন্য নিম্নোক্ত তিনটি পদ্ধতিতে সমিতির কার্যক্রম চালানো যেতে পারে- যথা : ১. বাইয়ে মুআজ্জাল (বাকি বিক্রি) ২. বাইয়ে সালাম (অগ্রিম ক্রয়) ৩. আকদে মুজারাবা (ব্যবসার অংশীদারিত্ব)।
বাইয়ে মুআজ্জাল:
গরহকের কোনো মালের প্রয়োজন থাকলে চাহিদা মোতাবেক সমিতি তা ক্রয় করে দখলে বুঝে নিয়ে গ্রাহকের কাছে বাকিতে বিক্রি করবে। সমিতি তার ক্রয়মূল্য ও খরচের সঙ্গে প্রস্তাবিত লাভ যোগ দিয়ে বিক্রয়মূল্য ধার্য করবে। ওই বিক্রয়মূল্য পরবর্তী সময়ে একবারে বা কিস্তি করে বহু বারে আদায় করবে। এ পদ্ধতিতে দু’টি বিষয়ে সতর্ক থাকতে হয়- ১. বিক্রির সময় যে বিনিময় ধার্য হবে পরবর্তী সময়ে কোনো কারণেই আর তার চেয়ে বেশি নেওয়া যাবে না। ২. গ্রাহককে মাল হস্তান্তর করতে হবে। মাল কিনে নেওয়ার জন্য গ্রাহককে বা তার প্রতিনিধিকে টাকা দেওয়া যাবে না।
বাইয়ে সালাম: গ্রাহকের যদি এমন প্রয়োজন দেখা দেয় যা পূরণে টাকা দরকার, কোনো মাল দ্বারা এ প্রয়োজন মেটানো সম্ভব নয়, সে ক্ষেত্রে সমিতি গ্রাহক থেকে কোনো মাল অগ্রিম ক্রয় করবে। তাকে মূল্য নগদ দিয়ে দেবে, মাল তার থেকে পরে নেবে। এ অগ্রিম ক্রয় শুদ্ধ হওয়ার জন্য মালের জাত, প্রকার, গুণগত মান, পরিমাণ, মাল হস্তান্তরের স্থান ও তারিখের পরিষ্কার বিবরণ চুক্তিতে উল্লেখ থাকা অপরিহার্য শর্ত। সমিতি ওই মাল বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করবে। এ পদ্ধতিতে সতর্ক থাকতে হবে যে, গ্রাহক থেকে মাল না নিয়ে মালের বাজারমূল্য নেওয়া যাবে না। তাকে মাল বিক্রি করে টাকা জমা দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া যাবে না। তার কাছে বেচা যাবে না। এসব কর্মকাণ্ড লেনদেনকে সুদে পরিণত করবে।
আকদে মুজারাবা: প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায় পুঁজির অংশ সরবরাহ করে সমিতি ব্যবসার অংশীদার হতে পারে। দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক বা বার্ষিক হিসাবে সমিতির প্রদেয় টাকার যে লাভ হবে তা থেকে পূর্ব নির্দিষ্ট অংশ (যেমন- অর্ধেক, এক-তৃতীয়াংশ) সমিতি গ্রহণ করবে। বাকিটুকু ব্যবসায়ী পাবেন। যদি ব্যবসায় লোকসান হয় তাহলে ব্যবসার মোট পুঁজির আনুপাতিক হারে লোকসানের দায় সমিতি নেবে।
সুদ ও মুজারাবার লাভের মধ্যে ৪টি স্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান।
১. সুদে বিনিয়োগকারী লোকসানের দায় নেবে না, কিন্তু মুজারাবায় বিনিয়োগকারী আনুপাতিক হারে লোকসানের দায়িত্ব নেবে।
২. সুদি বিনিয়োগে লাভ টাকার অঙ্কে নির্দিষ্ট থাকে কিন্তু মুজারাবায় তা থাকে না। বরং হার নির্দিষ্ট থাকে।
৩. সুদ বিনিয়োগকৃত ব্যবসার লাভের অংশ নয়। তাই লাভ না হলেও সুদ দিতে হয়। কিন্তু মুজারাবার প্রাপ্ত লাভ ব্যবসার লাভের অংশ, তাই ব্যবসায় লাভ না হলে বিনিয়োগকারী কিছুই পায় না।
৪. সুদ হ্রাস-বৃদ্ধির সম্ভাবনা রাখে না, কিন্তু মুজারাবার লাভ হ্রাস, বৃদ্ধি, শূন্য হওয়ার সম্ভাবনা রাখে।
সুদ বর্জনের প্রত্যয় নিয়ে সমিতি পরিচালনা করতে গেলে একটি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তা হলো- গ্রাহক যথাসময়ে মূল্য বা পণ্য না দিলে যদি বিলম্বের সময়ানুপাতে বেশি আদায় করা হয়, তাহলে তা সুদ হবে আবার আদায় না করলে এ সরলতা সবাইকে খেলাপি হতে উৎসাহ দেবে।
আমাদের বিজ্ঞ ফকিহদের সুচিন্তিত পরামর্শ হলো, সমিতির একটি জনকল্যাণ তহবিল রাখা। বিনিয়োগকালে গ্রাহক থেকে হলফনামা নেওয়া যে, খেলাপি হলে দিন, সপ্তাহ বা মাস হিসাবে এত টাকা করে জনকল্যাণ তহবিলে দান করব। ফলে বাড়তি টাকার চাপে খেলাপি হওয়ার কোনো প্রবণতা সৃষ্টি হবে না। কেউ খেলাপি হলে বাড়তি টাকা জনকল্যাণে ব্যয় হওয়ায় সমিতির সদস্যরা সুদ ভোগকারী হবে না।