সমবায় সমিতির সাথে আজকাল আমরা সবাই পরিচিত। বর্তমান সময়ে গ্রামে ও শহরে এমন এলাকা নেই যেখানে সমবায় সমিতি নেই। সমবায়ের মূলমন্ত্র হলো- ‘সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’। ‘দশে মিলে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ’- এই গল্প আমাদের সবারই জানা। আমাদের দেশে অনেক বড় কাজ বর্তমানে সমবায়ের মাধ্যমে সংঘটিত হচ্ছে, যা হয়তো কখনো একার পক্ষে করা সম্ভব হতো না। ১৯৮৪ সালের সমবায় অধ্যাদেশ এবং ১৯৮৭ সালের সমবায় বিধি অনুসারে সমবায় সমিতিগুলো পরিচালিত হচ্ছে।

সমবায় সমিতির সংজ্ঞা : সমশ্রেণীভুক্ত কতিপয় ব্যক্তি সমঅধিকার ও দায়িত্বের ভিত্তিতে পারস্পরিক কল্যাণের পক্ষে স্বেচ্ছায় মিলিত হয়ে আইন অনুযায়ী যে সংগঠন গড়ে তোলে তাকে সমবায় সমিতি বলে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) এর মতে- ‘‘সমাজের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের ব্যক্তিগণ সমঅধিকার ও দায়িত্বের ভিত্তিতে যে সংস্থা গড়ে তোলে তাকে সমবায় সমিতি বলে।’’ কোন বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে সম্মিলিত প্রয়াসই সমবায়। পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা, সুখ-দুঃখের অংশীদার হওয়া ইত্যাদিই সমবায়ের মূলকথা। আর পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা ব্যতীত গোটা বিশ্ব ব্যবস্থার অস্তিত্ব আজ হুমকির সম্মুখীন। একাকী মানুষ হিসেবে যে যত জ্ঞানী, বুদ্ধিমান, শক্তিধর অথবা বিত্তশালী হোক জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র সবকিছুকেই সে সংগ্রহ করতে পারে না। বরং জীবন ধারণের প্রতিটি স্তরে প্রত্যহ মানুষকে বহু লোকের মুখাপেক্ষী হতে হয়।

ইসলামে সমবায় সমিতি : সমবায়ের মাধ্যমে একে-অপরকে সহযোগিতা করে সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণ সাধনের প্রচেষ্টা অবশ্যই ইসলাম সমর্থিত একটি চমৎকার উদ্যোগ। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন- ‘‘সৎকর্ম ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে তোমরা পরস্পরকে সাহায্য করবে এবং পাপ ও সীমালঙ্ঘনে একে-অন্যকে সাহায্য করবে না। আল্লাহকে ভয় করবে, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ শাস্তিদানে কঠোর।’’ তাই শুধু আত্মপ্রতিষ্ঠা বা মুনাফা অর্জন নয় বরং ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠাই সমবায় সমিতির মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। ইসলামের দৃষ্টিতে সমবায়ের উদ্দেশ্য হবে বৃহত্তর মানব কল্যাণ, সংকীর্ণ দলীয় বা জাতীয় স্বার্থ নয়।

সমবায় সমিতির উদ্দেশ্য : সমবায় সমিতির বহুবিধ উদ্দেশ্য রয়েছে। যেমন- দীর্ঘ মেয়াদী লক্ষ্য অর্জন, আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন, মোটা অংকের মূলধন সৃষ্টি, নৈতিক শিক্ষা, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, সামাজিক উন্নয়ন, মধ্যস্থতাকারীদের উৎখাত, সেবার মানসিকতা, সামাজিক বন্ধন, সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করা, আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন, সঞ্চয়ী করে তোলা, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা, আইনগত সত্তা ও আদর্শ প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। তবে বহুধা উদ্দেশ্যের মধ্যে সমবায় সমিতির মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত- ‘‘দরদী সমাজ গঠনে অংশগ্রহণ করা এবং সমাজে আদল ও ইহসান প্রতিষ্ঠা করা’’।

সমবায়ের অপরিহার্যতা : সমবায়ের আদলে কাজ করে আজ তুরস্কের ইসলামপন্থী দল ক্ষমতায় এসেছে। অবশ্য এ জন্য প্রয়োজন সাহসী ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, সুষ্ঠু পরিকল্পনা, নিজেকে সমাজকর্মী মনে করা, ইসলাম প্রতিষ্ঠাকে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা ইত্যাদি। মুসলমানদের মনে রাখা দরকার- আল্লাহ মুসলমানদের মানুষের কল্যাণের জন্যই এই পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। এই দায়িত্বটি পালন না করলে কোরআনের ঘোষণা অনুযায়ী তাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে লাঞ্ছনা ভোগ করতে হবে।

সমবায়ের মূলনীতি : সেবা, সহযোগিতা, সমঝোতা, সততা, সম-ভোটাধিকার, সাম্যতা, একতা, গণতন্ত্র, স্বেচ্ছামূলক সংগঠন, মিতব্যয়িতা, সখ্যতা ইত্যাদি। সমবায়ের মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নের পাশাপাশি সমাজের ভাগ্য উন্নয়নেরও প্রয়াস থাকে। নিচে সংক্ষেপে দু’-একটি নীতি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :

একতা : ‘‘তোমরা আল্লাহ্র রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’’ (সূরা আলে ইমরান-১০৩)। একটি আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে জাতীয় ঐক্যের কোন বিকল্প নেই। তাই কুরআনুল কারীমের উপরোক্ত আয়াতে ঐক্যের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে এবং বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করতে নিষেধ করা হয়েছে। আয়াতে ‘আল্লাহ্র রজ্জু’ বলে কুরআনকে বুঝানো হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের রেওয়ায়েতে হুজুর (সাঃ) বলেন- ‘‘কুরআন অথবা দ্বীনকে রজ্জু বলার কারণ এই যে, এটা একদিকে আল্লাহ্ তা’য়ালার সাথে দুনিয়াবাসী মানুষের সম্পর্ক কায়েম করে এবং অন্যদিকে বিশ্বাস স্থাপনকারীদের পরস্পর ঐক্যবদ্ধ করে একদলে পরিণত করে। আয়াতে মুসলমানদের দু’টি নির্দেশ দেয়া হয়েছে-

১. আল্লাহ্ তা’য়ালার প্রেরিত জীবন ব্যবস্থার অনুসারী হয়ে যাও।

২. আল্লাহ্র দ্বীনকে সবাই মিলে শক্তভাবে ধারণ কর।

মুসলমানদের পারস্পরিক ঐক্যের ইতিবাচক দিক ফুটিয়ে তোলার পর নেতিবাচক দিক সম্পর্কেও সতর্ক বাণী উচ্চারণ করে বলা হয়েছে- পরস্পর বিভেদ সৃষ্টি করো না। অপর এক আয়াতে আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, ‘‘তোমরা নিজেদের মধ্যে বিভেদ করো না, করলে তোমরা সাহস হারিয়ে ফেলবে এবং তোমাদের শক্তি বিলুপ্ত হবে। আর তোমরা ধৈর্যধারণ করবে, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন’’। (সূরা আনফাল- ৪৬)। ‘‘নিশ্চিত এটি আমার সরল পথ। অতএব, এ পথে চল এবং অন্য পথে চলো না। তা হলে সে সব পথ তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে।’’ (আল্ আনআম- ১৫৩)

অনৈক্যের কুফল : অনৈক্য যে কোন জাতির ধ্বংসের সর্ব প্রথম ও সর্ব প্রধান কারণ। এ কারণেই কুরআনুল কারীমে বারবার বিভিন্ন ভঙ্গিতে অনৈক্যের বীজ বপন করতে নিষেধ করা হয়েছে। সূরা আল আন্আমে এসেছে- ‘‘নিশ্চয়ই যারা স্বীয় দ্বীনকে খন্ড বিখন্ড করেছে এবং অনেক দল হয়ে গেছে তাদের সাথে আপনার কোন সম্পর্ক নেই’’। (সূরা আল আনআম- ১৫৯)। এছাড়া কুরআন বিভিন্ন পয়গম্বরের উম্মতদের ঘটনাবলী বর্ণনা করে দেখিয়েছে যে, তারা কিভাবে পারস্পরিক মতবিরোধ ও অনৈক্যের কারণে জীবনের উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক লাঞ্ছনায় পতিত হয়েছে।

ঐক্যের মূল ভিত্তি : ঐক্যের ভিত্তি হিসেবে বিভিন্ন জাতি বিভিন্ন মত পোষণ করে থাকে। সাধারণত ভাষা, বংশ, অঞ্চল ইত্যাদিকে ঐক্যের ভিত্তি মনে করা হয়। কিন্তু ইসলামে ঐক্যের ভিত্তি হিসেবে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোকে বিবেচনা করা হয়।

ক. এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ্র আনুগত্য।

খ. আল্লাহ্র রাসূলের (সাঃ) পরিপূর্ণ অনুসরণ।

গ. কুরআন ও সুন্নাহকে জীবন পথের একমাত্র দিশারী হিসেবে গ্রহণ।

মুসলিম যে ভাষায় কথা বলুক, আর যে অঞ্চলেই জন্মগ্রহণ করুক না কেন তাদের ভাষা, বর্ণ, আকার আকৃতিতে যতই পার্থক্য থাকুক তাওহীদের প্রতি অবিচল ঈমান, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এর পরিপূর্ণ অনুসরণ ও অনুকরণ, আল্ কুরআন ও সুন্নাহকে দ্বিধাহীন চিত্তে মেনে নেয়ার মাধ্যমে মুসলিম জাতির মধ্যে কুরআনে বর্ণিত কাঙ্ক্ষিত ঐক্য গড়ে উঠতে পারে। সূরা সফে আল্লাহ্ যে ঐক্যের কথা বলেছেন নিম্নোক্ত ভাষায়, ‘‘আল্লাহ্ তো ভালবাসেন সেই সব লোকদের যারা আল্লাহ্র রাস্তায় ঐক্যবদ্ধভাবে এমনভাবে জিহাদ করে যেন তারা সীসাঢালা মজবুত প্রাচীর।’’

ইসলামী বিধান সমবায়ের সহায়ক : ইসলামের দৈনন্দিন পালনীয় বিধানাবলীর প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ইসলামের প্রতিটি বিধান সমাজে ঐক্য প্রতিষ্ঠার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির সহায়ক। দৈনিক পাঁচবার জামায়াতে নামায, শুক্রবারে জুমু’আর জামায়াত, ঈদের জামা’য়াত, হজ্জের মাধ্যমে বিশ্ব জামা’আত মুসলিমদের একতাবদ্ধ হওয়ার চিরন্তন আহবান। এছাড়া পারস্পরিক হিংসা, বিদ্বেষ, শত্রুতা, অন্যের অনিষ্টকরণ, দ্বনদ্ব-কলহ, কথাবার্তা বন্ধ রাখা, গীবত, অপবাদ, অন্যকে কষ্ট দেয়া, খারাপ ধারণা পোষণ, মহামারী আক্রান্ত এলাকা থেকে পলায়ন, কাউকে অবজ্ঞা, অধীনস্থ লোকদের কষ্ট দেয়া, বংশের গৌরব, অপরের অধিকারে হস্তক্ষেপ, ঝগড়া, পক্ষপাতিত্ব ইত্যাদি ঐক্য বিনষ্টকারী ভাইরাসকে সমূলে উৎপাটন করে সেখানে ভ্রাতৃত্বের চর্চা, সহানুভূতি, ভালবাসা, পরোপকার, পরস্পরকে সদুপদেশ, বিপদ-আপদে সাহায্য, সহমর্মিতা, সহাবস্থান, অপরকে অগ্রাধিকার, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা, মেহমান, প্রতিবেশী, ইয়াতিম, গরীব-মিসকিন, নারী সমাজের অধিকার আদায়, বড়দের প্রতি সম্মান, ছোটদের প্রতি স্নেহ, রোগীর সেবা, পরস্পরের কল্যাণ কামনা, সংশোধনের উদ্দেশ্যে গঠনমূলক সমালোচনা ইত্যাদি বিষয়কে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। যা বৃহত্তর ঐক্য বিনির্মাণে শুধু সহায়কই নয়, অনিবার্য অনুষঙ্গও বটে। জাতীয় ঐক্যের উপর ইসলাম প্রভূত গুরুত্বারোপ করে। আজকে বিশ্বের দিকে দিকে মুসলিম জাতির দুরবস্থা তা থেকে উত্তরণ পেতে হলে মুসলিমদের মাঝে বৃহত্তর ঐক্যের বিকল্প নেই।

সহমর্মিতা : রাসূল (সাঃ) বলেন- ‘‘পারস্পরিক দয়া, ভালবাসা এবং হৃদ্যতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে তোমরা মুসলিমগণকে একটি দেহের ন্যায় দেখতে পাবে। দেহের কোন অঙ্গ যদি পীড়িত হয়ে পড়ে তাহলে অপর অঙ্গগুলোও জ্বর ও নিদ্রাহীনতাসহ তার ডাকে সাড়া দিয়ে থাকে’’। (বুখারী, মুসলিম)

কুরআনুল কারীমে ও হাদীসে মুসলিম জাতির প্রতিটি সদস্যকে একে অপরের ভাই হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল্লাহ্ বলেন- ‘‘মুমিনরা তো পরস্পর ভাই ভাই’’ (সূরা হুজুরাত-১০)। এক ভাই অন্য ভাইয়ের সাহায্য সহযোগিতায় সব সময় তৎপর থাকবে, তার সুখে, দুঃখের অংশীদার হবে। তার অধিকার সম্পর্কে সর্বদা সচেতন থাকবে এটাই প্রকৃতির দাবি। আল্লাহ্র রাসূল (সাঃ) বলেন- ‘‘মুসলমান মুসলমানের ভাই। সে না তার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করতে পারে, না তাকে মিথ্যা বলতে পারে। আর না তাকে হেয়প্রতিপন্ন করতে পারে। বস্তুতঃ প্রত্যেক মুসলমানের মান-ইজ্জত, ধন-সম্পদ, ও রক্ত অন্য সব মুসলমানের উপর হারাম। (তিনি বক্ষস্থলের দিকে ইশারা করলেন)। তাকওয়া এখানে আছে। কোন ব্যক্তির খারাপ হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার মুসলমান ভাইকে ঘৃণা করে, তাকে হেয় প্রতিপন্ন করে’’। (তিরমিযী)

 সমবেদনা : এক মুসলমান অন্য মুসলমানের সংকটকালে আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে আসবে। তাকে সর্বদা সাহায্যের হস্ত সম্প্রসারিত করবে। নিম্নোক্ত হাদীসে এক মুসলমানের প্রতি অন্য মুসলমানের যে অধিকার বর্ণনা করা হয়েছে তা এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। ‘‘মুসলমানের একের উপর অন্যের ছয়টি হক রয়েছে। জিজ্ঞেস করা হলো- হে আল্লাহ্র রাসূল (সাঃ) সেগুলো কি? হুযুর (সাঃ) বললেন- যখন তুমি কোন মুসলিমের দেখা পাবে তখন সালাম দেবে। যখন কেহ তোমাকে দাওয়াত দেয় তার দাওয়াত কবুল করবে। কেহ উপদেশ চাইলে উপদেশ দিবে। হাঁচি দিয়ে যখন আলহামদুলিল্লাহ্ বলে তুমি তার জওয়াবে ইয়ারহামুকাল্লাহ (আল্লাহ তোমাকে দয়া করুন) বলবে। রোগাক্রান্ত হলে তাকে দেখতে যাবে। আর কেহ মরে গেলে তার জানাযা ও দাফনে শরীক হবে। (মুসলিম)।

সহযোগিতা : এক মুসলমানের বিপদাপদে যখন কোন মুসলিম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় তখন তার জন্য নির্ধারিত হয় বিরল মর্যাদা। হাদীসে এসেছে- ‘‘মুসলিমগণ পরস্পরের ভাই। সুতরাং সে তার ওপর কোন প্রকার যুলুমও করতে পারে না এবং তাকে অসহায় অবস্থায়ও ফেলতে পারে না। আর যে তার মুসলমান ভাইয়ের অভাব পূরণ করবে আল্লাহ্ তার অভাব পূরণ করবেন। অনুরূপভাবে যে কোন মুসলমানের দুঃখ দূর করে দিবে। আল্লাহ্ কিয়ামতের দিন তার দুঃখ দূর করে দিবেন। আর যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের ত্রুটি গোপন করে রাখবে, আল্লাহ্ হাশরের দিন তার ত্রুটিও গোপন করে রাখবেন’’। (বুখারী, মুসলিম)

সমব্যথী : কোন মুসলিম ভাই যদি কোনরূপ অপকর্মে লিপ্ত হয় তাকে দূরে ঠেলে নয় বরং তার সমব্যাথী হয়ে সে দোষ থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করতে হবে। হাদীসে এসেছে- রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেছেন- ‘‘তোমাদের প্রত্যেকেই নিজ মুসলিম ভাইয়ের আয়নাস্বরূপ। অতএব, সে যদি তার মধ্যে কোন দোষ ত্রুটি লক্ষ্য করে তবে তা যেন দূর করে দেয়’’। (তিরমিযী)। আমরা চিন্তা করলে দেখব ইসলামের প্রায় সকল ইবাদত অনুষ্ঠান যেমন সালাত, সাওম, যাকাত, হজ্জ ইত্যাদি সত্যিকার অর্থে এক মুসলমানকে আরেক মুসলমানের সহমর্মী সমব্যাথী করে তোলে।

একটি আদর্শ সমবায়ের দৃষ্টান্ত : বিশ্ব মানবতার মহান মুক্তিদূত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্বেই ‘‘হিলফুল ফুজুল’’ নামক সমবায় গঠনের মাধ্যমে সমাজের কল্যাণ সাধনের প্রচেষ্টা করেছিলেন। মাত্র ২৭ বছর বয়সে ফুজ্জার যুদ্ধের বিভীষিকাময় পরিণতির প্রেক্ষাপটে নিজ চাচা যুবাইরসহ উক্ত সমবায় গঠন করেছিলেন। এই সমবায়ের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি ছিল নিম্নরূপ :

১. দেশ থেকে অশান্তি দূর করার যথাযথ প্রয়াস চালানো।

২. প্রবাসীদের জীবন সম্পদ মান সম্মান রক্ষার্থে সদা সচেষ্ট থাকা।

৩. বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে সম্প্রীতি ও সদ্ভাব স্থাপনের চেষ্টা করা।

৪. অত্যাচারীর হাত হতে অত্যাচারিতদের রক্ষা করা।

৫. অত্যাচারীকে প্রাণপণে প্রতিহত করা।

যদিও নবী করীম (সাঃ) নবুয়ত পূর্ব জীবনে উক্ত সমবায় গঠন করেছিলেন। তথাপি উপরোক্ত সমবায় বর্তমানের যে কোন সমবায়ের জন্য মডেল হতে পারে। কেননা এর প্রত্যেকটি ঘোষণা কুরআন হাদীস সম্মত।

প্রথম দফা কর্মসূচি অশান্তি দূর করে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আল্লাহ্ বলেন, ‘যারা আল্লাহ্র সন্তুষ্টিলাভ করতে চায়, ইহা দ্বারা তিনি তাদের শান্তির পথে পরিচালিত করেন এবং নিজ অনুমতিক্রমে অন্ধকার হতে বের করে আলোর দিকে নিয়ে যান এবং তাদের সরল পথে পরিচালিত করেন।’ (মায়িদা-১৬)। অন্যত্র আল্লাহ্ বলেন- ‘দুনিয়ায় শান্তি স্থাপনের পর তোমরা উহাতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না। তাকে ভয় ও আশার সাথে ডাকবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্র অনুগ্রহ সৎকর্ম পরায়নদের নিকটবর্তী।’ (আরাফ- ৫৬)

দ্বিতীয় দফা কর্মসূচি তথা অন্যের সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব পালনে উৎসাহ দিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থ সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না এবং মানুষের ধন সম্পত্তির কিয়দংশ জেনে শুনে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে তা বিচারকদের নিকট পেশ করো না।’ (বাকারা- ১৮৮)

রাসূলুল্লাহর (সাঃ) বিদায় হজ্জের ভাষণেও উক্ত কথার প্রতিধ্বনী শোনা যায়, ‘তোমাদের এ শহর এ মাস এ দিনটি যেমন পবিত্র ও সম্মানিত তেমনি তোমাদের রক্ত, সম্পদ ও মান ইজ্জতকেও আল্লাহ তোমাদের পরস্পরের জন্য সম্মানিত ও পবিত্র করে দিয়েছেন।’ (বুখারী)

তৃতীয় দফা বা পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সদ্ভাব সৃষ্টি সমবায়ের আরেক মৌলিক দিক। ইসলাম সকল মানুষের সাথে সুসম্পর্ক ও সদ্ব্যবহার শিক্ষা দেয়। কুরআনের ভাষণ : ‘প্রত্যেক মুমিন ভাই ভাই সুতরাং তোমরা তোমাদের ভাইদের মধ্যে সমঝোতা ও সদ্ভাব প্রতিষ্ঠা কর।’ (সূরা হুজুরাত : ১০)

হাদীসে এসেছে, ‘মুসলমান মুসলমানের ভাই। সে তার প্রতি অত্যাচার করবে না। মহানবী (সঃ) নিজ বুকের দিকে ইশারা করে তিনবার বললেন, তাকওয়া এখানে। নিজ মুসলিম ভাইকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও ঘৃণা করা অন্যায়। প্রত্যেক মুসলিমের জন্য অন্য মুসলিমের রক্ত, সম্পদ ও সম্মান সবই হারাম।’ (মুসলিম)

পারস্পরিক সদ্ভাব ও সম্প্রীতির ব্যাপারে কুরআনের আরেকটি আয়াত পাণিধানযোগ্য : ‘তিনি তাদের অন্তরের মধ্যে প্রীতি স্থাপন করেছেন। পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদ ব্যয় করলেও তুমি তাদের মনে প্রীতি সঞ্চার করতে পারতে না; কিন্তু আল্লাহ্ তাদের মধ্যে প্রীতি স্থাপন করেছেন। নিশ্চয়ই তিনি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।’ (আনফাল-৬৩)

চতুর্থ ও পঞ্চম ঘোষণা অনুযায়ী অত্যাচারীকে প্রতিরোধ ও অত্যাচারিতকে রক্ষা করা প্রতিটি মুসলিমের অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য। আল্লাহ্ বলেন, ‘যারা সীমালংঘন করেছে তোমরা তাদের প্রতি ঝুঁকে পড়ো না; পড়লে অগ্নি তোমাকে স্পর্শ করবে। এই অবস্থায় আল্লাহ্ ব্যতীত তোমাদের কোন অভিভাবক থাকবে না এবং তোমাদের সাহায্য করা হবে না।’ (হুদ-১১৩)

হাদীসে এসেছে- ‘‘তোমরা তোমাদের ভাইকে সাহায্য কর, সে জালিম হোক আর মাজলুম হোক এখানে জালিমকে তার জুলুম থেকে বিরত রাখাই তাকে সাহায্য করা’’।

একটি হকপন্থী সমাজে সমবায় প্রতিষ্ঠা করে পারস্পরিক সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমে সমাজের প্রতিটি অন্যায়, অধিকার, জুলুম ও সংকট উত্তরণে সমবায়ীরা রাখতে পারে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আল্লাহ্র রাসূল (সাঃ) বলেন- ‘‘তোমাদের মধ্যে কেউ মন্দ কাজ হতে দেখলে সে তা শক্তি দ্বারা পরিবর্তন করবে। যদি সে এর শক্তি না রাখে তবে মুখ দ্বারা, আর যদি এর শক্তিও না রাখে তবে অন্তর দ্বারা চিন্তা করবে। আর এটাই হল ঈমানের দুর্বলতম স্তর’’। (মিশকাত)

উপসংহার : সমাজে প্রচলিত কিছু কিছু সমবায় সমিতি সুদ, ঘুষ, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন রকম পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত। আবার অনেক সমবায় সমিতির সমাজ ও সংগঠনের প্রতি কোন ধরনের আদর্শিক কমিটমেন্ট নেই, শুধুমাত্র মুনাফা অর্জন এবং আত্মপ্রতিষ্ঠাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। এর বিপরীতে ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে সমবায় গড়ে উঠলে তা আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তাই আমরা মুসলমান হিসেবে সমাজের প্রতি দায়িত্ব বোধের কারণে সমবায়ের মাধ্যমে দুনিয়ায় আবার ইসলামকে কালজয়ী আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

কি খুজছেন এখানে লিখুন